৬ বছরের তাইয়েবাকে হারিয়েও দুশ্চিন্তা থামেনি পরিবারের। মামলা তুলে নিতে তাদের দেওয়া হচ্ছে দফায় দফায় চাপ। মামলা না তুললে ১২ বছর বয়সী তাইয়েবার ভাই সাকিনকেও হত্যার হুমকি দিচ্ছে আসামিপক্ষের লোকজন। সোমবার সকালে বাড়িতে গেলে তাইয়েবার মা ডলি আক্তার সমকালের কাছে এসব অভিযোগ করেন।
তাইয়েবা শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার সখিপুর থানাধীন ছৈয়ালকান্দি গ্রামের টিটু সরদারের মেয়ে। একই এলাকার দারুণ নাজাত মাদ্রাসায় নার্সারিতে পড়ত সে। গত বুধবার নিখোঁজ হয় শিশুটি। অনেক খোঁজাখুঁজির পর শুক্রবার প্রতিবেশী মেসবাহউদ্দীন মোল্লার বাসার সেপটিক ট্যাংকে পাওয়া যায় তাইয়েবার মরদেহ।
শুক্রবার রাতেই এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাইয়েবার চাচি আয়েশা বেগম, প্রতিবেশী নাসিমা ও রংমিস্ত্রি আসিফকে থানায় নেওয়া হয়। প্রাথমিক তদন্তের পর পুলিশ জানায়, পারিবারিক বিরোধ ও শত্রুতার জেরে চাচি আয়েশাই শিশুটিকে হত্যা করেছেন। তিনি একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক।
এ ঘটনায় টিটু সরদার বাদী হয়ে সখিপুর থানায় মামলা করেন। থানার ওসি মো. ওবায়দুল হকের ভাষ্য, তিন আসামিকে গ্রেপ্তার করে রোববার তারা আদালতে সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন। আদালত আয়েশা বেগমের দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।
এদিকে শিশুটির পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, রোববার সকালে তাইয়েবার মা ডলি আক্তারকে বাড়িতে এসে মামলা তুলে নিতে হুমকি-ধমকি দেন মামলার প্রধান আসামি আয়েশা বেগমের স্বামী সাহান সরদার, ছেলে আকিব সরদার, ননদ রিনা ও রুমা। এ সময় আকিব ও রিনা বলেন, মামলায় আপস না করলে তাইয়েবার মতো তার (ডলি) ছেলেকেও হত্যা করা হবে। এ ছাড়াও তাইয়েবা হত্যার বিচার দাবিতে মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করা শিক্ষার্থীদেরও তারা হুমকি দিয়েছে বলে জানা গেছে।
ডলিকে আকিব ও রিনা হুমকি দিয়ে বলেছেন, ‘মামলা উঠাইয়া না নিলে তোর পোলারে খাইয়া ফালামু। তোর পোলারে শেষ দেখা দেইখা রাখিস। তোর মাইয়ার তো লাশ পাইছোস; পোলার লাশ খুঁজে পাবি না।’
এসব তথ্য জানিয়ে আজ সকালে কান্নাজড়িত কণ্ঠে ডলি বলেন, ‘আমার মেয়েকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। এখন আমি ন্যায়বিচার চাই। উল্টো হুমকি দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, মামলা না তুললে আমার আরেক সন্তানকে খুন করবে। আমি দিনরাত আতঙ্কে আছি। আমি প্রশাসনের কাছে নিরাপত্তা চাই।’ এ ছাড়াও রাজনৈতিক নেতা পরিচয়ে আসামিপক্ষের সঙ্গে মীমাংসা করতে হুমকি পেয়েছেন বলে জানান তিনি।
টিটু সরদার বলেন, ‘আমরা এখন বাড়ি থেকে বের হতেও ভয় পাচ্ছি। আমার ছেলে স্কুলে ও বাড়ির বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। কে কখন কী করবে, সেই ভয়ে আমরা কাঁপছি। বিচার চাইতে গিয়ে মনে হচ্ছে, আরও বিপদ ডেকে আনলাম। ওরা প্রকাশ্যে যেভাবে হুমকি দিচ্ছে, মনে হয়, মামলায় আপস না করলে আমাদের মেরে ফেলবে। আমি মরণ হলেও মেয়ে হত্যার বিচার চাই। দেশবাসীর কাছে দোয়া ও নিরাপত্তা চাই।’
প্রতিবাদীদেরও হুমকি
তাইয়েবা হত্যার প্রতিবাদে রোববার সকালে এলাকাবাসী প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেন। পরে তারা সখিপুর থানা ঘেরাও করে আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। এতে অংশ নিয়েছিল দশম শ্রেণির ছাত্রী লামিয়া। সোমবার সকালে সে অভিযোগ করে, ‘আমি স্কুলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মানববন্ধনে আসার পথে সাহান সরদার (আয়েশার স্বামী) আমাকে বলে, আমরা যদি মানববন্ধন করি তাহলে আমাদের লাশ খুঁজে পাওয়া যাবে না। আয়েশার ছেলে (আকিব) আমাদের মানববন্ধনে এসে সবার ভিডিও করে নিয়ে গেছে। ওরা বলছে, কাউকে স্কুলে আসতে দেবে না। আমরা এগুলো ভয় পাই না। তাইয়েবা হত্যার বিচার চাই।’
টিটুর প্রতিবেশী আবুল কাশেম মিয়া মনে করেন, শিশুহত্যার মতো জঘন্য অপরাধের বিচার না হলে সমাজে ভয়ংকর দৃষ্টান্ত তৈরি হবে। আর বাদীকে যদি এভাবে হুমকি দেওয়া হয়, তাহলে কেউই আর মামলা করতে সাহস পাবে না। প্রশাসনের উচিত দ্রুত সময়ের মধ্যে মামলা তদন্ত করে হত্যায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করা। আয়েশার স্বামী সাহান সরদার ও ছেলে আকিব সরদার, ননদ রিনা ও রুমাকে আটক করলে এ হত্যাকাণ্ডের অনেক তথ্য পাওয়া যাবে। যেহেতু তারা মামলা উঠিয়ে নিতে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে, তাদেরও আটক করা উচিত।
এ বিষয়ে সখিপুর থানার ওসি মো. ওবায়দুল হক বলেন, হত্যাকাণ্ডে জড়িত সব আসামিকে আইনের আওতায় আনতে কাজ করছে পুলিশ। বাদী পরিবার হুমকির বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দিলে পুলিশ তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেবে। তাদের নিরাপত্তায় পুলিশ প্রস্তুত। হুমকিদাতাদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করা হবে।
